Most-Popular

ঘটি vs বাঙাল! এত জনপ্রিয় কেন? কেনই বা করা হয় ঘটি – বাঙাল আজও?

অফিসের ক্যান্টিন হোক কি কলেজের কমনরুম বা ট্রেনের কামরা এইসব জায়গাতে আজও যে টপিক সব আলোচনা ছাপিয়ে আসর সরগরম করে তোলে তা হলো ঘটি বনাম বাঙাল বিতর্ক। যুগপ্রাচীন এই দড়ি টানাটানি ধর্মে, কর্মে, আচারে, বিচারে এক সনাতন আবেগ এর বিষয়। ঘটিরা যদি বাঙালদের প্রিয় শুঁটকির নাম শুনলে নাক সিঁটকোয় তবে বাঙাল রাও ঘটিদের ঝাল তরকারিতে চিনি দেওয়াকে সহ্য করতে পারেনা মোটেই।

ঠারেঠোরে একে অন্যকে লোটা ও মাচা বলে বিদ্রুপ চলতেই থাকে। তবে এটাকে বিভেদ হিসেবে অনেকেই বর্তমানে দেখেন না বরং রসিকতা ও চুলোচুলির মাধ্যম বলেই উপভোগ করে থাকেন। আজকের প্রতিবেদনে আমরা এই ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব এর দিকগুলি দেখবো মজাচ্ছ্লেই। কোনো জাতিগত বিদ্বেষ বা ভাবাবেগকে আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

ঘটি বাঙাল ইতিহাস:

যারা আমরা এত ঘটি-বাঙাল শব্দ নিয়ে চর্চা করি অথচ এটার ইতিহাস অনেকেই জানিনা। চলুন দেখে নি।

  • ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গের প্রায় দেড় কোটি বাঙালী মানুষজন এপার বাংলায় বা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরা এই দেশে বসতি স্থাপন করেন এবং এদেরই বাঙাল বলা হয়ে থাকে।
  • অন্যদিকে যাদের পূর্বপুরুষরা যুগের পর যুগ ধরে পশ্চিমবঙ্গেই বাস করছেন তাদের বলা হয় ঘটি।
  • কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগেনা যে ঘটি আর বাঙাল এই দুটি নাম কেন বলা হয়? বাঙাল শব্দের ভৌগোলিক উৎপত্তি ‘বঙ্গাল’ থেকে। যার অন্তর্গত ছিল পূর্ববঙ্গ ও দখিনবঙ্গ অর্থাৎ সমুদ্রতট কেন্দ্রিক অঞ্চলসমূহ। কলকাতার বাবু সংস্কৃতির দৌলতে ওপার বাঙলার শরণার্থীদের নাম বাঙাল। খানিকটা উপহাস করেই।
  • অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রাতঃকৃত্য এর জন্য ঘটি ব্যবহারের চল ছিল। তাই বাঙালরা তাদের ঘটি নামে খেপিয়ে তুলতো।
  • ঘটি রাও তাদের কাঁটাতার পেরোনো উদ্বাস্তু বলতে ছাড়ত না অবশ্য।
  • বাঙালরা ওপাশ থেকে এলেও মনে রাখতে হবে দেশ স্বাধীন করার জন্য সবচেয়ে বেশি বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছেন ওদিক থেকেই।
  • পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ থাকলে ওদেরও জীবনানন্দ রয়েছেন।

খেলার মাঠে ঘটি – বাঙাল ম্যাচ

  • সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল। তাই ঘটি বাঙাল তরজা ঘিরেও ফুটবলের যোগ তো থাকবেই।
  • ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ফুটবল ম্যাচের রেষারেষি ঘিরে ঘটি বাঙালের তুমুল উত্তেজনা রয়েছে আজও। দুইদল যতই ভালো খেলুক শেষ মুহূর্ত অব্দি বলা যায় না কে জিতবে।
  • গ্যালারি জুড়েই কিন্তু সমানে সমস্বরে নিজের দলের হয়ে গলা ফাটানো চলতে থাকে। এই দুই দলের জন্যই ফুটবল আজও বাঙালীর প্রাণ।
  • ১৯১১সালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার এর ইংরেজদের পরাজিত করে ঘটিদের ক্লাব সবুজমেরুন মোহনবাগান। কিন্তু ঐতিহাসিক সেই আই এফ এ শিল্ড জয়ের নায়ক দলের আটজনই ছিলেন পূর্ববঙ্গের। তাই ঘটি বাঙালের যোগসূত্র ওতপ্রোতভাবে গাঁথা।

হেঁসেলের লড়াইয়ে ঘটি বনাম বাঙাল

  • ভুরিভোজের কথা হবে আর বাঙাল ঘটি প্রসঙ্গ উঠবেনা তাই কখনো হয় নাকি! বস্তুত বাঙাল ঘটি আসল লড়াই তো রান্নাকে ঘিরেই।
  • রান্না কার ভালো সেই নিয়ে ঘটি বাঙালের বাগ-বিতন্ডার শেষ নেই। হেঁসেলের চাপান উতরেও কেউ কারোর চেয়ে কম যায় না।
  • ঘটিরা যদি শুঁটকি নিয়ে কথা শোনায় তো বাঙালরাও আলুপোস্ত খাওয়া নিয়ে ঘটিদের খোঁটা দেয়। বাঙালরা যদি বলে এরা সব রান্নায় মিষ্টি দেয় তো ঘটিরাও এটা বলে জব্দ করে যে বাঙালরা রান্নায় আলুর খোসা অব্দি বাদ দেয় না।
  • তবে অবশ্যই ঘটিদের ও বাঙালদের সিগনেচার ডিশ হলো যথাক্রমে – চিংড়ির মালাইকারী ও ইলিশের ভাপা বা সর্ষে ইলিশ। যেটা নিয়ে তারা গর্ব অনুভব করে।
  • তবে দুটি পদই যে ভোজনরসিক বাঙালীর অত্যন্ত আদরের সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

পুজা অর্চনায় ও রয়েছে ঘটি বাঙাল

  • মোটামুটি ভাবে ঘটি বাঙালদের অন্য সব পুজো পদ্ধতি এক হলেও লক্ষীপুজো নিয়ে দুই জাতির অবস্থান দুই মেরুতে। এটাতে তাদের আলাদা আলাদা রীতি ও নিয়ম পালিত হয়।
  • বাঙালদের লক্ষ্মীপূজো মানে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো জেটার গোড়াপত্তন পূর্ব বাংলায় – ময়মনসিংহ, বিক্রমপুর, সিলেট ইত্যাদিতে।
  • অন্যদিকে ঘটিদের পুজোয় নিরামিষ ভোগই মাকে অর্পণ করা হয়ে থাকে।
  • বাঙালদের পুজোয় তিলের নাড়ু, মুড়কি, মোয়ার মতো বিশেষ মিষ্টান্ন এর সাথে থাকে ইলিশ মাছ। খিচুড়ির সাথে পোলাও উৎসর্গ করা হয়ে থাকে।
  • দেশভাগের সময় এদেশে আসার পর চরম দুঃখ দুর্দশার মধ্যে নিজেদের আর্থিক মঙ্গলের জন্য তারা কলা মান্দাসের ভেলা ও ধানের শীষ দিয়ে পুজো ও করেন। যেটা তাদের স্বতন্ত্র কৃষ্টির পরিচায়ক।

ভাষার পার্থক্য খাইমু বনাম খেয়েছি

  • বাঙালরা রেগে গেলে একটা কথা বলেই থাকেন তা হলো – “মাইয়্যা কাইট্যা ফেলাইমু” বা বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো ইত্যাদি।
  • তবে শুধু তাই নয় বাঙালদের ভাষায় অপিনিহিতির প্রভাব দেখা যায়। যার জন্য তারা খাইমু, জাইমু, খাইবা,করবা ইত্যাদি বলে থাকেন।
  • অন্যদিকে ঘটিরা রাঢ় বাংলায় কথা বলেন যেমন খেয়েছি, এসেছি, গিয়েছি ইত্যাদি।

মোদ্দাকথা হলো আপাত ভাবে ঘটি বাঙালের সম্পর্ক যতই আদায় কাঁচকলায় থাক তারা পরস্পরকে ছাড়া থাকতে পারেনা। ঠিক টম আর জেরির মতোই। একে অপরের সংস্কৃতির আদানপ্রদানে সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের। কচুর লতি, পুঁইশাক ঢুকে পড়েছে ঘটির হেঁসেলে আবার বাঙালরাও মিষ্টি দিতে শিখেছে নিজেদের রান্নায়।একে অপরকে নিয়ে লড়াই এর মধ্যেও রয়েছে রসিকতার খুনসুটি।

Biswarup Parichha

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

3 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

3 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

3 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

3 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

3 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

3 বছর ago