ধর্ম ও সংস্কৃতি

মা আসছেন জানুন কীভাবে ডাকলে মনোবাসনা পূর্ণ হবে সহজে!

বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজো আর হাতে গোনা কয়েক দিনের অপেক্ষা। তারপর পঞ্চমী থেকে নবমীর হই হুল্লোড়, প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ঘোরা, লাইনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাকুর দেখার জন্য অপেক্ষা, মোবাইলের মেমোরি ভর্তি প্রচুর সেলফি, খাওয়া দাওয়া আর শপিং যেন একটা গতে বাঁধা রুটিন। কিন্তু এই বাইরের জৌলুস ছাড়াও দুর্গাপুজো অনেক বেশি আন্তরিক, মানুষের অনেক বেশি কাছের।

এ পুজো যে ঘরের মেয়ের বাপের বাড়ি আসা। তাই দশমীর দিন উমার বিদায়বেলায় ঢাকের আওয়াজের সাথে সাথেই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, মন খারাপ সঙ্গী হয়। বছরের এই কটা দিন দেবীর মর্ত্যে আগমনকে কেন্দ্র করে যেমন হুলুস্থূলুস কান্ড বাঁধে, পুজো অনুষ্ঠান যাগ-যজ্ঞ কতকিছু শুরু হয়, ঠিক তেমনি জগত জননীর কাছে দীনদুখী থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের আকুতি, প্রার্থনা, অভাব-অভিযোগ সব মিলেমিশে থাকে। কিন্তু কেমনভাবে ডাকলে দেবী প্রসন্না হন? কীভাবে ডাকলে মনোবাসনা পূর্ণ হয় সহজেই-তা জানা আছে কি? চলুন জেনে নিই।

ক. মন্ত্রে বাসনা পূরণঃ

১. বিপদ থেকে উদ্ধারের মন্ত্রঃ

সংসারের হাজার‌ও অশান্তি, পায়ে পায়ে চলতে বিপদ, এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য পঞ্চমী থেকে দশমীর দিন একশো আট বার এই মন্ত্র জপ করুন।

মন্ত্রঃ

“শরণাগত দীনার্ত
পারিত্রান পরায়াণে।
সর্বস্যার্তি হরে দেবী।
নারায়নী নমোহস্তুতে।”

২. ঐশ্বর্য প্রাপ্তি, রূপ যশ প্রাপ্তি,ও সুস্থ নীরোগ থাকার জন্য মন্ত্রঃ

দুর্গাপুজোয় চারদিন শুদ্ধ বস্ত্রে ১০৮ বার করে এই মন্ত্র জপ করতে হয় তাহলে সৌভাগ্য প্রাপ্তির সাথে সাথে সুস্থ নিরব দেহ লাভ হয় হয়। জপ আসনে বসার আগে সামনে দেবী দুর্গার একটি ছবি অবশ্য‌ই রাখবেন। আবার সারা বছর এই মন্ত্র স্নান করে উঠে ১১ বার করে জপ করতে পারেন, সারাবছর জপ করবার সময় অন্তরে দেবী দুর্গার অসুরদলনী রূপকে স্মরণ করবেন।

মন্ত্রঃ

“দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি
দেবী পরম সুখম।
রূপং দেহি জয়ং দেহি
যশো দেহি দ্বিষো জহি।”

৩. অবিবাহিতের বিবাহের জন্য মন্ত্রঃ

প্রতিদিন ২৫৬ বার করে এই মন্ত্র শুদ্ধমনে জপ করলে অবিবাহিতের বিবাহের যোগ উপস্থিত হয়।

মন্ত্রঃ

“ভার্যাং মনোরমাং দেহি
মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্।
রুপং দেহি জয়ং দেহি
যশো দেহি দ্বিষো জহি।”

৪. অযাচিত শত্রু নাশের জন্যঃ

আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ বন্ধুর মুখোশের আড়ালে থেকে শত্রুতা করে, এবং হাসি হাসি মুখে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, অযাচিত শত্রুর এই প্রয়াস যাতে সফল না হয়, অযাচিত শত্রুর দ্বারা আমাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য একটি মন্ত্র আছে। এই মন্ত্র প্রতিদিন ১০৮ বার করে জপ করা উচিত।

মন্ত্রঃ

“সর্ব বাধা প্রশমনং
ত্রৈলোক্যস্যাখিলেশ্বরী।
এবমেব ত্বয়া কার্যমন্মদ
বৈরী বিনাশনম।”

৫. সর্ব কাজে সাফল্য লাভের জন্যঃ

যেকোনো কাজে সাফল্য লাভ করবার জন্য ও বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য দুর্গার একটি মন্ত্র আছে যা জপ করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে। তবে এই জপমন্ত্রের কোন নির্দিষ্ট জপ সংখ্যা নেই, সারাদিনে যতবার পারা যাবে ততবার জপ করা শ্রেয়।

মন্ত্রঃ

“ওঁ হ্রীং দুর্গে দুর্গে
রক্ষণী রক্ষণী স্বাহা।”

৬. জীবনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যঃ

যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো অবস্থায় জীবনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবার জন্য এই মন্ত্র পাঠ করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়। এই মন্ত্র প্রতিদিন ১০৮ বার করে জপ করতে হয়।

মন্ত্রঃ

“সৈব কালে মহামারী
সৈব সৃষ্টির্ভবত্যজা।
স্থিতিং করোতি ভূতানাং
সৈব কালে সনাতনী।”

৭. বিদ্যা ও কর্ম লাভের জন্যঃ

বিদ্যাস্থানে শুভ ফল লাভ করবার জন্য ও কর্ম লাভ করবার জন্য প্রত্যহ এই মন্ত্র ৪৩২ বার করে জপ করা উচিত।

মন্ত্রঃ

“বিদ্যাবন্তং যশস্বন্তং
লক্ষীবন্তঞ্চ মাং কুরু।”

খ. মহাঅষ্টমীর দিন নিম্নলিখিত কার্যগুলি শুভফল প্রদায়কঃ

  • ১. দুর্গাপুজার অষ্টমী তিথিতে উপবাস রেখে দেবী দুর্গার চরণে একটি কড়ি রাখুন ও অষ্টমীর পুজোর শেষে সেই কড়ি সকলের অগোচরে আপনার বাড়ির মধ্যে নিত্য পূজিত ঠাকুরের স্থানে এনে রাখুন।
  • ২. দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন শুদ্ধ বস্ত্র পরে দেবী দুর্গার ১০৮ নাম জপ করুন ও দুর্গা চালিশা পাঠ করুন।
  • ৩. দুর্গাপুজার অষ্টমীর দিন উপবাস রেখে দেবী দুর্গার চরণে ১০৮ টি নীল পদ্ম নিবেদন করুন।
  • ৪. দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন বাড়িতে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ প্রতিষ্ঠা করুন ‌এতে সংসারের কল্যাণ হয়।
  • ৫. দুর্গাপুজার অষ্টমীর দিন প্রসন্ন চিত্তে নয়জন কুমারী মেয়কে বাড়িতে নিয়ে এসে তাদেরকে ভালো সুস্বাদু খাবার খাওয়ান ও তাদের পা ধুইয়ে আলতা পরিয়ে দিন। এতে দেবী মায়ের কৃপায় আপনার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে।

গ. আচরণের মধ্য দিয়ে বাসনা পূরণঃ

  • দেবী দুর্গা জগত জননী, তাই সারা বছর কোন অনাথ বা মাতৃহীন বা পিতৃহীন সন্তানের প্রতি অকারণে বা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রূঢ় আচরণ করবেন না। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসহায় কোন মানুষের চোখের জল ঝরাবেন না বা নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য কখনো কাউকে ব্যবহার করবেন না।
  • দেবীর কাছে নিজের মঙ্গল কামনার চাইতে তাঁর সমগ্র সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করুন। কারণ মায়ের কাছে তার সকল সন্তানের জন্য প্রার্থনা করলে তিনি এমনি খুশি হয়ে যান আর সৃষ্টির মঙ্গলের মধ্যে আপনার‌ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে তবে এই নিঃস্বার্থ চাওয়ার জন্য দেবী আপনার প্রতি কৃপা দৃষ্টি দান করবেন।
  • সারাবছর নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী গরিব- দুঃখী- অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান, সেই সাহায্য আপনি অর্থ দিয়ে করতে পারেন, পরামর্শ দিয়ে করতে পারেন অথবা বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়ে করতে পারেন। তবে কারো সাহায্য করে বিনিময়ে কোন কিছু আশা করবেন না, বরং দেবী যে আপনাকে অন্যের বিপদে দাঁড়ানোর সামর্থ্য দিয়েছেন তার জন্য নিজেকে ধন্য বলে মনে করুন।
  • বাবা,মা, ভাই বোন, সন্তান, স্বামী অথবা স্ত্রীয়ের  প্রতি আপনার যা কর্তব্য তা পালন করুন। এদের মধ্যে কেউ যেন আপনার দ্বারা অত্যাচারিত না হয়।
  • নিজের বাক্য দ্বারা, নিজের আচরণ দ্বারা, নিজের শিক্ষা দ্বারা কখনো কোন অসহায় বা দুর্বল মানুষকে আঘাত করবেন না। অহংকার কে নিজের মনের মধ্যে ঠাঁই দেবেন না।
  • আপনি যদি আপনার মনকে সংযত করতে পারেন ও দেবীর চরণে সম্পূর্ণরূপে শরণাগত হতে পারেন তাহলে কেউ কখনই আপনার কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবেনা। স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলে গিয়েছেন, একহাতে সংসার করতে আর অন্য হাতে ভগবানকে ধরতে, সংসারের সকল দায়িত্ব কর্তব্য পালন করলেও মনে মনে ভগবানকে বা জগতজননী মাকেই আপনজন বলে জানবার শিক্ষা তিনি দিয়ে গিয়েছেন।‌
  • সেই সঙ্গে তিনি আরো বলেছেন যে কেউ যদি নিজের পূর্ব কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সেই পাপ কাজ আর করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তাহলে ভগবান তাকে ক্ষমা করেন। আবার সারদা মা বলেছিলেন ( পূর্বকৃত জন্মের কর্মফল) প্রারব্ধ কর্ম ভোগ করতেই হয়, তবে ভগবানের নাম করলে যার পা ভাঙার কথা ছিল তার পায়ে হয়তো কাঁটা বেঁধে। এইভাবেই ভগবানের শরণাগত ভক্ত সমস্ত বিপদ পার করে দেয় হাসিমুখে।
  • তাই মহাপুরুষদের বাণী শুধু মুখস্ত না করে তাদের বক্তব্যকে চিরসত্য রূপে অনুভব করে নিজের মানসিক গঠন সেইভাবে করুন। অর্থাৎ দেবী দুর্গা মাকে নিজের সবথেকে আপনার মানুষ ভেবে তার চরণে শরণাগত হন। একজন শরণাগত ভক্তের পাপ, পূণ্য থেকে শুরু করে বিপদ- আপদ, রোগ- বালাই কোনোকিছুর চিন্তা থাকেনা। শরণাগত ভক্তের ভাব হয়,“ মা আমি তোমার, তুমি আমার হাত ধরো।”
  • দেবীর শরণাগত হ‌ওয়ার মন্ত্রঃ “মাগো আমার পাপ পুণ্য, জীবন-মরণ সব তোমার হাতে, সব তুমি জানো। আমাকে শুধু তোমার চরণে ঠাঁই দাও, আমি তোমার শরণাগত হয়ে যেন জন্ম-জন্মান্তর কাটিয়ে দিতে পারি। আমার আর কিচ্ছু চাইনা।” – এই কথা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সর্বক্ষণ মনে মনে ভেবে গেলে মনে ভক্তি আসে ও ভক্ত ভগবানের শরণাগত হয়ে যায় আর এই এক শরণাগতির সাথে সাথেই জীবনের সকল ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটে। তাই এই শরণাগতিই হলো জীবনের পরম মন্ত্র।
Sangita Chowdhury

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago