চৈত্র মাসের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়ক পুজো। সারা পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উৎসব পালনের রেওয়াজ রয়েছে।
চৈত্র মাসের শেষ দিনে শুরু হয়ে বৈশাখের প্রথম দুই থেকে তিন দিন এই চড়ক উৎসব চলে। এই চড়ককে শিবঠাকুরের গাজন উৎসবের একটি অন্যতম অঙ্গ হিসাবে ধরা হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কিন্তু বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে এবং তা চলে বেশ কয়েকদিন ধরে।
পূরাণ কী বলে?
পূরাণ অনুসারে চড়ক পুজোর উল্লেখ কোথাও নেই। কিন্তু লিঙ্গপূরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপূরাণে চৈত্র মাসে শিব ঠাকুরের আরাধনা, পূজা-অর্চনা, নাচ-গানের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
বলা হয় ১৪৮৫ খ্রীষ্টাবেদে রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর প্রথম এই পুজোর প্রচলন করেন। কথিত রয়েছে, দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে শিবের একনিষ্ঠ উপাসক বাণরাজার যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে মহাদেবের কাছ থেকে অমরত্ব লাভ করার জন্য নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে মহাদেবকে তুষ্ট করেন এবং ভক্তিমূলক নাচগানও করেন।
সেই থেকে শৈব সম্প্রদায়ের মানুষরা শিবপ্রীতি থেকেই এই উৎসব পালন করে আসছে।
পুজোর বিধি, আচার এবং অনুষ্ঠান
চড়ক পুজোর শুরুতে শিব পাঁচালী পড়ার রীতি আছে। পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা মহাদেবের নামে ধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান।
স্নানের পর মাটির কলসিতে করে জল ভরে আনেন তাঁরা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় সমবেত হন সন্ন্যাসীরা।
শিব পাঁচালী পাঠ তখনও চলতে থাকে। এরপর ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে অন্য জায়গায় চলে যান। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়।
সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিদ্ধ করে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন। অনেকে আবার সন্ন্যাসীরদের আর্শীবাদ লাভেরজন্য শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা।
সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন। এই অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘোরাতে থাকেন এবং অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছুঁড়ে দেন ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা।
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, এ জগতে যারা মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এমন কঠিন আরাধনার পথ বেছে নেন, তাদের মৃত্যুর পর স্বর্গে যাওয়ার বর দেন মহাদেব।
এই চড়ক পুজোই হল গম্ভীরা এবং শিবের গাজনের রকমফের।
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
আবার এই পুজোরই আর এক অঙ্গের নাম নীলপুজো। পুজোর আগে চড়কগাছের তল এবং চড়কগাছটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া হয়। এরপাশেই একটি পাত্রে জল ভরে তাতে শিব ঠাকুরের মূর্ত প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়।
তবে অনেকসময় আবার একটি লম্বা কাঠের তক্তায় সিঁদুর মাখিয়েও রাখা হয়, যাকে বলা হয় ‘শিবের পাটা’। আর এটাই সকলের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে প্রচলিত। এই নামের সঙ্গে আশা করি অনেকেই পরিচিত।
প্রথা
এই পুজোর কিছু বিশেষ অঙ্গ রয়েছে, যা আজও কিছু কিছু জায়গায় চরম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। যেমন, জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটা, ছুরি এবং কাঁটার ওপর লাফানো, কুমিরের পুজো, শিবঠাকুরের বিয়ে, আগুনের ওপর নাচ করা, চড়কগাছে দোলা ইত্যাদি।
এই পুজোর ক্ষেত্রে সবথেকে উল্লেকযোগ্য যে বিষয়টি তা হল দৈহিক যন্ত্রণা, যাকে এই পুজোর এক বিশেষ অঙ্গ বলে মনে করা হয়।
বলা হয় প্রাচীন কৌম সমাজে প্রচলিত নরবলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে এই পুজোর রীতি-নীতিতে।
সর্বপরি এই পুজোর মূলে রয়েছে ভূত-প্রেত এবং পূনর্জন্মের গাঁথা। এই পুজোর অঙ্গ হিসাবে ভক্তরা এবং সাধু-সন্তরা হুড়কো দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুত বেগে ঘুরিয়ে থাকে।
আবার লোহার শলাকা তাদের পায়ে ,হাতে, গায়ে, পিঠে, এমনকি জিহ্বাতেও প্রবেশ করানো হয়। এমনকী কখনও কখনও জ্বলন্ত লোহার শলাকা শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও প্রবেশ করানো হয়।
তবে ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ণ করে এই নিয়ম-নীতি বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু আজও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এইসব নিয়ম-নীতি প্রচলিত রয়েছে।
এবছরের পুজোর সময়
৩০ শে চৈত্র সোমবার (ইংরেজি ১৩ এপ্রিল)মহাবিষুব সংক্রান্তি ও শ্রী শ্রী চড়ক পূজো। দিবা ১১টা ৩৮গতে সংক্রান্তিকৃত্য ও স্নানদানাদি।
জল ফল অন্ন ও দান সংক্রান্তি ব্রত।
জল পূর্ণ ঘটদানে সর্ব্বপাপ ক্ষয় ফল।
শিব নারায়ন অশ্বত্থ ও তুলসী বৃক্ষাদিতে জলধারা দান। অর্থাৎ তুলসী গাছ ও অশ্বত্থ গাছে জল দিলে পূণ্য অর্জন হয়।
গোস্বামী মতে শ্রী শ্রী কেশব ব্রতারম্ভ। চৈত্র সংক্রান্তি। অসমে বহাগ বিহু ও রঙ্গালী বিহু।