Personal Care

বেটনোভেট সি মাখলেই ফর্সা! এই ফাঁদে ভুলেও পা দেবেন না। পরিনতি হতে পারে ভয়ানক!

চৌদ্দ বছর বয়সী বানিক নিজের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল শুধুমাত্র তার প্রতিবেশীর কথায়। সেই প্রতিবেশীর মেয়ে এক নতুন ক্রিমের কল্যাণে ফর্সা হয়ে যায়, যা বানিকের মায়ের নজরে আসে।

নিজের মেয়ের আগামী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রতিবেশীর পরামর্শমতো মেয়েকে সেই নতুন ক্রিম কিনে দেন। ক্রিমের মোড়ক অন্যান্য সব স্কিন ক্রিমের চাইতে দেখতে ভিন্ন হলেও বানিকের মা খুব একটা পাত্তা দেন নি। শুধুমাত্র মেয়ের রং ফর্সা হবে এই চিন্তায় তিনি বিভোর ছিলেন।

সেই প্রতিবেশীর মেয়ের মতো বানিকও ক্রিম ব্যবহার করে দৃশ্যমান ফলাফল পেয়েছিল। কিন্তু ব্যবহারের ঠিক দুইমাসের মাথায় বাড়ে বিপত্তি। জাদুর মত কাজ করা ক্রিম রং ফর্সা করার সাথে আরো যা যা ক্ষতি করেছিল, তা সারাতে বানিকের লেগে যায় পাক্কা ৬ বছর।

বানিকের ব্যবহৃত সেই জাদুকরী ক্রিমটি ছিল বেটনোভেট সি বা বেটামেথাসোন। এবং আজকের আর্টিকেলে রয়েছে বেটনোভেট সি আদ্যোপান্ত। যদি আপনিও হোন বানিকের মতো একজন, তাহলে লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।

বেটনোভেট সি বা বেটামেথাসোন কি?

বেটামেথাসোন মূলত একটি টপিকাল কর্টিকোস্টেরয়েড ওষুধ। এই ওষুধ স্কিনের বিভিন্ন জটিল সমস্যা, যেমন সোরিয়াসিস এবং একজিমা সারানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। মজার ব্যাপার হল, এই ওষুধের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার একটি হচ্ছে ত্বকের রং হালকা করা। অর্থাৎ এটি ত্বকে ফর্সাভাব এনে দেয়, যা পরবর্তী সর্বনাশ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।

ভুল ব্যবহারবিধি এবং ফলাফল

নির্দিষ্ট রোগ এবং সময়সীমা ছাড়া এই ক্রিম ব্যবহার করলে আপাতদৃষ্টিতে ত্বকের রং ফর্সা হয়। কিন্তু তৈরি হয় ফটোসেনসিটিভিটি। সূর্যের আলোর নিচে গেলেই ত্বকে জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়। এমনিতে বেটামেথাসোন ক্রিমে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকলেও ভুল ব্যবহারবিধির কারণে তা-ই উল্টো ত্বকে জ্বলুনির উদ্রেক করে।

এছাড়াও ত্বকে চুলকানি ভাব, অ্যাকনে, মুখের ত্বকে অবাঞ্ছিত লোম গজানো ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ত্বকের অনেক জায়গা জুড়ে র্যাশ উৎপন্ন হয় এবং ত্বক অনেক বেশি রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই কর্টিকস্টেরয়েড ওষুধ ত্বককে ফর্সা করার পাশাপাশি ত্বককে কালো বানিয়েও ফেলতে পারে৷

ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, বেটামেথাসোন ব্যবহার চাইলেও বন্ধ করা যায় না। বন্ধ করলেই অ্যাকনে, ড্রাইনেস, র্যাশ, লাল ছোপ ইত্যাদি মারাত্মকভাবে স্কিনে হানা দেয়। ফলে ভুক্তভোগীরা না চাইতেও বেটনোভেট সি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়।

কেন এত জনপ্রিয়?

  • বেটামেথাসোন এবং হালোবেটাসোল নামের দুইটি কর্টিকোস্টেরয়েড ক্রিমের জনপ্রিয়তার পিছনে মূল থিওরি হলো এদের ‘রং ফর্সার করার ক্ষমতা’। এগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা-বেচা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। তবুও ঐ একটি কারণে অবাধে কেনা-বেচা চলছে এবং ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
  • বিশেষজ্ঞদের মতে, ওষুধের বাজারের চরম দুর্নীতি, সরকারের উদাসীনতা, এবং আইন প্রয়োগের শিথিলতা হচ্ছে এই ওষুধগুলো লাগামছাড়া হওয়ার অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন-এর করা জরিপ থেকে এই তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
  • একটি জরিপ করা হয়েছিল দিল্লী, কলকাতা, আহমেদাবাদ, এবং হায়দ্রাবাদের ১৬টি ফার্মেসীর উপরে। এদের মধ্যে মাত্র ১টি ফার্মেসীর কর্মচারীরা জানে যে এই ওষুধগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা-বেচা সম্ভব না। কিন্তু তবুও তারা ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কাজটি করছে।
  • ৫টি ফার্মেসী জানেই না এই ওষুধগুলোর প্রকৃত কার্যকারিতা সম্পর্কে। তবুও তারা সেগুলো বিক্রি করেছে সিএনএন জেরা করা সত্ত্বেও। বাকি ১০টি ফার্মেসী সিএনএন-এর জেরাকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে এবং বিক্রি করেছে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই।
  • তবে কর্টিকোস্টেরয়েড যে শুধুমাত্র বেটামেথাসোন এবং হালোবেটাসোল ক্রিমে আছে তা কিন্তু নয়। বাজারের অন্যান্য রং ফর্সাকারী ক্রিমেও কর্টিকোস্টেরয়েড থাকে কিন্তু মোড়কে সেটা উল্লেখ করা থাকেনা। দামিশেট্টি নামক একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ একবার একটি বিখ্যাত রং ফর্সাকারী ক্রিম নিয়ে গবেষণা করেন।
  • তিনি ঐ ক্রিমটিতে ০.০৫৬ শতাংশ বেটামেথাসোন খুঁজে পেয়েছিলেন। নিয়মিত ঐ ক্রিম ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারী নিজের অজান্তেই বেটামেথাসোনে আসক্ত হয়ে পড়বে – এমনটাই দাবি করে দামিশেট্টি তার গবেষণার ফল লোকাল মিডিয়াতে প্রকাশ করেছিলেন।
  • কিন্তু ঐ ক্রিম উৎপাদনকারী সংস্থা পাল্টা প্রতিবাদ জানিয়ে দামিশেট্টিকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠায়। এরপরে এই ব্যাপারটা বেশীদূর এগোতে পারেনি। তার উপর কোভিড মহামারী এসে পড়াতে বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যায়।

স্টেরয়েড স্কিন ক্রিম এবং আমাদের সমাজ

বেটামেথাসোনের মত স্টেরয়েড স্কিন ক্রিম নিয়ে এত হৈচৈ হতো না যদি না আমাদের সমাজ সৌন্দর্য নিয়ে এতটা উন্মাদ না হতো। সমাজে কালো রংকে এতটাই ঘৃণা করা হয় যে তার জন্য স্টেরয়েড মেশানো রং ফর্সাকারী ক্রিম এমনকি ওষুধ পর্যন্ত ব্যবহারের হিড়িক পড়ে যায়।

কালো বর্ণের মেয়েদের যেন সুন্দর স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার নেই। হয় মোটা অংকের পণ দাও নয়তো সারাজীবন কুমারী থাকো। যেহেতু ‘বিয়ে’ হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিচিতি, সেহেতু ফর্সা হওয়াটা অতীব জরুরি।

২০১৪ সালে দক্ষিণপশ্চিম দিল্লীর একটি শহর গুরুগ্রামে এক মহিলা আত্মহত্যা করেন তার গায়ের রং নিয়ে স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অনবরত বিদ্রূপের কারণে। এর ঠিক এক বছর পরে কলকাতার এক স্কুলশিক্ষিকা শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। কারণটা ছিল একই, তার ময়লা রংয়ের কারণে পাত্র জোটানো কঠিন হয়ে যাবে।

এ তো কেবল খন্ডচিত্র। এক গায়ের রংকে কেন্দ্র করে এরকম ঘটনা আরো বহু আছে। বেটামেথাসোন নিয়ে জলঘোলা কিন্তু কম হয় নি। ২০১৭ সালে বেটামেথাসোন সহ আরো ১৪ টি টপিকাল স্টেরয়েড স্কিন ক্রিমের অবাধ লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

বণিকের পরিবারের মত হাজারো বণিক স্টেরয়েড স্কিন ক্রিম ব্যবহার করবে শুধু মাত্র ভালো বর পাওয়ার জন্য। এদের কাছে ফর্সা চামড়া হচ্ছে সকল সুখের চাবিকাঠি। বিয়ের আগে রং ঠিক না করলে সমাজে মুখ দেখানোর যে জো থাকেনা। তাই রং ফর্সা করার আগে চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি ফর্সা করাটা দরকার।

আফরোজ হেলাল

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago