Personal Care

জেনে নিন রূপচর্চা ও ঘরোয়া চিকিৎসায় মেহেদির ১৩টি ব্যবহার

বৈজ্ঞানিকভাবে Lawsonia Inermis নামে পরিচিত মেহেদি নারী এবং পুরুষ উভয়ই প্রধানত রূপচর্চার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু মেহেদির রয়েছে আশ্চর্য ঔষধি গুণ৷ রূপচর্চার পাশাপাশি চিকিৎসাতেও মেহেদি ব্যবহার করা যায়, যা হয়তো অনেকেই জানেন না। বর্তমান মেডিকেল সাইন্সের ভীড়ে মেহেদির গুণাগুণ অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে।

যেকোন অনুষ্ঠানে হাত রাঙাতে মেহেদির জুড়ি নেই। পছন্দমত ডিজাইনে হাত দুটো লাল টুকটুকে করতে কার না ভাল লাগে? অনেকে আবার মেহেদি দিয়ে নখও রাঙাতে পছন্দ করেন, যা হচ্ছে ন্যাচারাল নেইল পলিশ। পাকা চুল ঢাকতে বা চুলের স্বাভাবিক রং উজ্জ্বল করতেও মেহেদি এক নম্বরে থাকবে।

কিন্তু বাহ্যিকভাবে ব্যবহার ছাড়াও শুধুমাত্র মেহেদি দিয়েও অনেককিছু করা সম্ভব। এই মাত্র একটি উদ্ভিদ আপনাকে ছোটবড় অনেক শারীরিক সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি দিবে। আজকে আপনাদের জানাব টুকটাক রূপচর্চাসহ ঘরোয়া চিকিৎসায় মেহেদির ১৩টি ব্যবহার সম্পর্কে।

তবে চলুন তার আগে জেনে নেই মেহেদির ভেষজ গুণাবলি সম্পর্কে।

মেহেদির ভেষজ গুণ কি কি

চিরসবুজ উদ্ভিদ মেহেদির মূল, পাতা, ফুল, ফল সবই ব্যবহারযোগ্য। এর ফুলগুলো দেখতে ছোট ছোট, সাদা আর হালকা গোলাপি রঙের হয় এবং লাইলাক ফুলের মত সুবাস থাকে। এই ফুল মূলত ইনসমনিয়া কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এক কথায় মেহেদিকে সিডেটিভ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়।

ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছ মেহেদির আছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ। এটা কোন ক্ষত বা ব্যথায় কুলিং ইফেক্ট আনে, দ্রুত নিরাময় করে। আবার মেহেদির রস খেলে শরীরের ভিতরকার অনেক জটিল রোগও নিরাময় করা সম্ভব। মেহেদিপাতার রাসায়নিক গঠনে আছে গ্লিকোসাইড, এসেনশিয়াল অয়েল, হেনোট্যানিক অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যালকোহল ইত্যাদি।

জন্ডিস দূর করবে মেহেদি

জন্ডিসের মত কঠিন রোগ দূর করতে মেহেদি কিন্তু দারুণ কাজ করে। তবে এর জন্য একটু খাটতে হবে। প্রথমে আধাকোটা আতপ চাল ধোয়া পানিতে ভালমত ধুয়ে সেই পানিটা জমিয়ে রাখুন। এবারে মেহেদি গাছের কচি মূল চন্দন পাটায় নিয়ে ঐ চাল ধোয়া পানির সাথে ভাল করে বেটে নিন।

বাটার পরে যেই লিকুইডটা বের হবে, সেটা আবারও ঐ চাল ধোয়া পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। এক্ষেত্রে বাটা মূলের পরিমাণ থাকবে ২ চামচ আর চাল ধোয়া পানির পরিমাণ হবে ৮ থেকে ১০ চামচ৷ এই দুটো জিনিস মিলিয়ে সকালে ও বিকালে দুইবার খেতে হবে। নিয়ম করে ৪/৫ দিন খেলে জন্ডিস সেরে যাবে।

উড়িষ্যার এই টোটকা পদ্ধতি জন্ডিস নিরাময়ে প্রসিদ্ধ। যতদিন এই টোটকাটা নিবেন, ততদিন এর পাশাপাশি ডাবের পানি বা আখের রস অবশ্যই খাবেন। এখানে যে পরিমাণটা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য উপযোগী। ছোট বাচ্চা বা কিশোর বয়সের কারো জন্য উপাদানের পরিমাণ পরিবর্তন হবে।

ব্রণের সমস্যায় মেহেদি

ব্রণের সমস্যা তো মহা সমস্যা। পার্টিতে যাবেন, আগের রাতে মুখে ব্রণ আবিষ্কার করলেন। ব্যস হয়ে গেল সাজগোজ পন্ড। ব্রণ ঢাকতে গাঢ় মেকআপ করলে আবার উল্টো ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। ব্রণের জন্য ফেসপ্যাক করারও সময় নেই। তাহলে কি করা যায়?

ছোট্ট একটা কাজ করে সহজেই ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। পানিতে ৮ থেকে ১০ টি মেহেদি পাতা দিয়ে ফুটিয়ে নিন। কুসুম গরম হয়ে আসলে ঐ ফুটানো পানি মুখ ধুয়ে নিতে পারেন। ব্রণ দূর হয়ে যাবে। যতদিন না ব্রণ হালকা হচ্ছে ততদিন এটা ব্যবহার করবেন।

তবে ব্রণের সমস্যা সাংঘাতিক আকার ধারণ করলে মেহেদি কাজ না-ও করতে পারে।

হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নির্ধারণ করতে

শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে ঘটে নানা অঘটন। এমন সব রোগ শরীরে বাসা বাঁধবে, যাতে মৃত্যু অবধারিত। দৈনিক কাজের চাপে শরীরে হিমোগ্লোবিন চেক করার সময় না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কাজেই মেহেদি দিয়ে নিজেই নিজের হিমোগ্লোবিন চেক করুন।

প্রথমে মেহেদিপাতার রস হাতের তালুতে লাগান। যদি হিমোগ্লোবিন ঠিক থাকে তাহলে রংটা লালচে আভায় রূপ নিবে। উল্টোটা হলে মেহেদির রং ফিকে বা কালচে রূপ ধারণ করবে, আর তাতেই সতর্কঘন্টা বাজবে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, কিভাবে মেহেদির এই পরীক্ষা দিয়ে হিমোগ্লোবিন নিয়ে সময় থাকতে সচেতন হবেন। প্রাচীনকাল থেকে এই পদ্ধতি রাজস্থানের বৈদ্য সম্প্রদায় অনুসরণ করে আসছে।

বলিরেখা দূর করুন

বলিরেখা দূর করতেও মেহেদিপাতা অনন্য। তবে এটা হাতের মত মুখকেও লাল করে দিবে না। আপনার রেগুলার ফেসপ্যাকে ৫ থেকে ৬ ফোঁটা মেহেদিপাতার রস মিশিয়ে ব্যবহার করুন। খেয়াল রাখবেন ফেসপ্যাকটা যেন ১০ মিনিটের বেশি না থাকে মুখে। প্রতিদিন এভাবে ব্যবহার করলে বলিরেখা ফিকে হতে থাকবে।

পা ফাটা রোধ করবে মেহেদি

শীতকালে পা ফাটার যন্ত্রণায় ভোগেন সবাই, আবার অনেকের বারো মাসই পা ফাটে। শুধু মেহেদি দিয়েও পা ফাটা রোধ করতে পারেন অনায়াসেই৷ এক মুঠো মেহেদিপাতা বেটে ফাটা পায়ের উপর পুরু করে প্রলেপ দিয়ে ৩০ মিনিট রাখুন। প্রতিদিন এই মেহেদিপাতার প্রলেপ ব্যবহার করলে পা ফাটা দূর হবে শতভাগ।

পায়ের জ্বালাভাবও দূর করে

বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা ইনফেকশন থেকে হতে পারে পায়ে জ্বালাপোড়া। এটা নিরাময়ের জন্য একটা সহজ সমাধান বলে দেই৷ ২/৩ টা মেহেদিপাতা প্রথমে ভিনেগারে ভিজিয়ে নিন, তারপরে সেই পাতা কয়টি মোজার ভিতর রেখে দিন। রাতে শোয়ার সময়ে সেই মোজা পুরে ঘুমাবেন, এতে পায়ের জ্বালাপোড়া কমে যাবে অনেকখানি।

পায়ের ঘা দূর করতে

যারা ভেজা পরিবেশে থাকেন বা কাজ করেন (যেমন সাঁতারু বা পাবলিক বাথ ব্যবহারকারীরা), তাদের পায়ে অ্যাথলেট’স ফুট নামক ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন দেখা দেয়। এই ইনফেকশন পায়ের আঙ্গুলের মাঝে বা নিচে ঘায়ের সৃষ্টি করে।

ডাক্তারি ট্রিটমেন্ট ছাড়াও ঘরে বসে মেহেদিপাতা দিয়ে এর চিকিৎসা করতে পারবেন। মেহেদিপাতা বেটে পেস্ট করে ঘায়ে লাগিয়ে নিন। আবার যদি নোংরা বা অপরিষ্কার পানি থেকে পায়ে ঘা হয় তাহলেও মেহেদির পেস্ট লাগাতে পারবেন। দিনে দুইবার করে দিলে ঘা সারবে দ্রুত।

কুঁচকানো চামড়া স্বাভাবিক করতে

অনেকেরই মুখের বা গায়ের চামড়া কুঁচকে যায় বা ঢিলে হয়ে যায়। মেহেদিপাতার রস থেকে তৈরি তেল প্রয়োগে কুঁচকানো চামড়া স্বাভাবিক হয়ে যায় কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। অবশ্য এক্ষেত্রে মেহেদির তেলের বদলে ঘি-ও ব্যবহার করা যায়।

চুলকানি/ঘা শুকাতে

শরীরের যেকোন জায়গায় ঘামাচি, র্যাশ, ঘা, বা চুলকানি দূর করার জন্য মেহেদি জাদুকরী সমাধান। মেহেদিপাতা বেটে এর পেস্ট ঘামাচি, জ্বালাপোড়া, বা চুলকানির জায়গায় লাগিয়ে দিন। ঘামাচি এবং চুলকানি কমে যাবে নিমিষেই।

ক্ষত নিরাময়ে মেহেদি

বহু পুরনো ক্ষত বা বারবার ফিরে আসছে এমন ক্ষত সারাতে মেহেদি কাজে লাগাতে পারেন। একমুঠো পাতা বেটে ক্ষতের উপর লাগিয়ে রাখলে ক্ষত থেকে মুক্তি মিলবে।

চোখের রোগে মেহেদি

কি, অবাক হচ্ছেন? মেহেদি দিয়ে চোখ উঠা বা চোখের কোণের পুঁজ বের হওয়াটাও রোধ করা সম্ভব। চোখ উঠলে প্রথমে ৫/৬টি মেহেদিপাতা ধুয়ে থেতলে নিন। এবার সেই থেঁতলানো পাতা গরম পানিতে ফেলে রাখুন ৩০ মিনিট। ৩০ মিনিট পরে সেই পানিটা ছেঁকে চোখে ২/৩ ফোঁটা দিলে চোখ উঠা সেরে যাবে। একই পদ্ধতিতে চোখের কোণ থেকে পুঁজের মত জিনিস বের হওয়াটাও আটকানো যাবে।

শরীরের দুর্গন্ধ দূর করুন মেহেদি দিয়ে

গ্রীষ্মকালে যাদের শরীর প্রচুর ঘেমে দুর্গন্ধ বের হয়, তারা বেণামূল এবং মেহেদিপাতা সিদ্ধ পানিতে গোসল করুন। তাহলে শরীরে আর বাজে গন্ধ হবেনা।

নখকুনি নিরাময় করুন

নখের কোণে নখকুনি উঠলে ঘন করে মেহেদিপাতা বেটে দিনে দুইবার নখের কোণে লাগাবেন।

মেহেদি আরো কি কি কাজে ব্যবহৃত হয়

রূপচর্চায় মেহেদি তো কাজে লাগেই, এছাড়াও বহু রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে মেহেদি কার্যকরী৷ মুখের ভিতরের ঘা সারাতে, পেটের সমস্যা, দাঁতের যন্ত্রণা, বসন্ত, কাঁধের ব্যথা, জরায়ু সরে যাওয়া, শ্বেতপ্রদর, কানের পুঁজ বন্ধ, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, টাক পড়া, মাথাব্যথাসহ আরো নানা কাজে মেহেদির রস বা রস থেকে তৈরি তেল কাজে লাগে। রোগ নিরাময়ে মেহেদি ব্যবহার করার সময় সঠিকভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সতর্কতা

  • বাড়িতে মেহেদিবাটা ব্যবহারের আগে অবশ্যই পাতাগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিবেন।
  • অর্গ্যানিক মেহেদি ব্যবহারে কোনপ্রকার অস্বস্তি দেখা গেলে সাথে সাথে ব্যবহার বন্ধ করে দিবেন।
  • চুল, নখ, হাত সাজানোর জন্য কখনোই বাজারের মেহেদির উপর ভরসা করবেন না। আমরা অনেকেই আমদানিকৃত মেহেদিকে কোয়ালিটিফুল মনে করে কেনার জন্য মুখিয়ে থাকি৷ কিন্তু বিদেশি মেহেদির প্যাকেটের গায়ে লেখা উপাদানগুলো না বুঝেই ব্যবহার করতে থাকি। যার ফলে ঘটে যায় চামড়া পোড়াসহ আরো নানা মারাত্মক দুর্ঘটনা। চুলে ব্যবহার করলে চুল পোড়া, ভেঙে যাওয়া, মাথার তালু জ্বলে যাওয়া ঘটতে পারে। তাই যত কষ্টই হোক, সময় নিয়ে বাড়িতে মেহেদি বেটে নিজেকে সাজাতে হবে।
  • মেহেদি ব্যবহারকালে অন্য কোন প্রাকৃতিক বা রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার না করাই ভাল। নাহলে দ্বিগুণ অ্যাকশনে রোগ ভাল হওয়ার বদলে উল্টো বেড়ে যেতে পারে।
আফরোজ হেলাল

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago