স্বাস্থ্য

নারী স্বাস্থ্য দৈবর হাতে…

নারী স্বাস্থ্য দৈবর হাতে…

ভারতীয় পুরাণে, নারী আদি শক্তির প্রতীক – প্রধান আরাধ্য দেবী, জন্মদাত্রী। কিন্তু যেখানে ডাক্তারী গবেষণা এবং নারীদের স্বাস্থ্যের কথা আসে, সেই স্থানে আমাদের সমাজে নারীদের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা একেবারেই ভুলে যাওয়া হয়ে।

আমরা অনেক সময় দেখী কোন মহিলা এক নির্দিষ্ট অসুস্থতা বা অস্বাস্থ্য থেকে ভুগছেন কিন্তু তার বাড়ির পুরুষেরা সেটাকে শুধু মাত্র মানসিক চাপ বা প্যারানয়া বলে অগ্রাহ্য করা যায়। সাধারণ অসুখ হলেও মহিলাদের ক্ষেত্রে রোগের ভুল নির্ণয় বা ভুল চিকিৎসা হওয়া কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না কারণ নারীদের স্বাস্থ্য ও রোগ সম্পর্কিত গবেষণা এবং সচেতনতা খুবই সীমিত।  তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত এখনো আমাদের পুরুষ প্রাধানিক সমাজ হিসেবে পুরুষ স্বাস্থ্যের তথ্য থেকেই নেওয়া হয়।

যে বিশ্বে ঔষধ ও প্রযুক্তিবিদ্যা এত উন্নতি করেছে এবং যেখানে নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক কথোপকথন সবার আগে হয়, সেখানে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এই ধরনের একটি পরিস্থিতি চলতেই থাকে এবং নারীদের স্বাস্থ্য সম্বদ্ধিত সব প্রকল্প শুধুমাত্র একটি সুদীর্ঘ বিতর্ক হয়ে থেকে গেছে।

নারী স্বাস্থ্য আজও গৌণ পর্যায় কেন?

  • গবেষণার অভাব: স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে নারী স্বাস্থ্যের গবেষণা শুধুমাত্র গর্ভাবস্থা এবং সন্তান জন্মদান পর্যন্ত সীমিত থেকে গেছে। অন্যান্য রোগ যা মহিলাদের শরীরে ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়, তার অধিকাংশই সাধারণত একটি পুরুষ স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়। এর পিছনে মূল কারণ হল যে একই রোগ পুরুষ ও নারী স্বাস্থ্যে ভিন্নভাবে প্রকাশ হতে পারে এটা মেনে নেওয়ার অনিচ্ছা।

 

গবেষণা সাধারণত পশুদের একটি নমুনা বা পুরুষদের এবং মহিলাদের একটি নমুনা মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে করা হয়; গবেষণার ফলাফল খুবই সাধারণ ভাবে বিচার করা হয়, কোন বিশেষ লিঙ্গ পরিপ্রেক্ষিতে সেটা কে দেখা হয় না। সম্ভবত, এই প্রবণতা দেখা দেয়  বিশ্বে দুই লিঙ্গের ভারসাম্যহীনতার কারণে। ডাক্তারী তর্কে বলা হয়ে যে শারীরিক পরীক্ষার সময় লিঙ্গ নির্ধারণের দরকার হয়ে না যদি না পরীক্ষা কোন লিঙ্গ নির্দিষ্ট অঙ্গের উপর করা হয়। এই পরীক্ষার পদ্ধতি ব্যর্থ কারণ সেটা এই বিবেচনা করেনা যে মহিলা শরীরে হর্মোনসের উপস্থিতি  রাসায়নিক ভাবে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তিত করে দিতে পারে।

 

  • পুরুষকেন্দ্রিক সমাজ: আজকের যুগে অনেক কিছু বদলেছে এবং নারীরা এখন অনেক বেশী সম্মান ও মর্যাদার পাত্রী। কিন্তু স্ত্রীজাতি মানেই তারা স্বভাবত দুর্বল সেই মানসিকতা এখনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চিন্তাকে শক্তি ও সহনশীলতার অভাব বলে অগ্রাহ্য করা হয় এবং তা ঠাট্টার বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যতক্ষনে চিকিৎসককে জানানো হয়ে ততক্ষনে শরীর রোগে যর্যরিত এবং ক্ষতির মাত্রা চিকিৎসার বাইরে।

 

  • ভুল ব্যক্তিকে ভুল প্রশ্ন: তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে এই অবজ্ঞার মনোভাব দেখে আতঙি্কত হয়ে মহিলারা বেশীরভাগ সময় ভুল ব্যক্তির থেকে ভুল পরামর্শ নেয়। যেখানে একটু সহানুভূতি দেখে সেদিকে যায়ে এই আশায় যে কেউ তাদের সমস্যা বুঝবে। কিন্তু এটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়। সঠিক বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া চিকিৎসা পদ্ধতির প্রথম ধাপ। কিন্তু নারী স্বাস্থ্য সম্বন্ধিত সচেতনতা না হলে এই ভুল বারবার হবে।

 

  • ব্যক্তিগত দ্বিধা: বেশিরভাগ সময়ে, নারীরা এতো সংশয়ী এবং দ্বিধাগ্রস্ত থাকে তাদের সমস্যা নিয়ে যে তারা পরিষ্কারভাবে তাদের সমস্যা জানায়না। লোকে জানলে কি ভাববে এই ভেবে রোগের লক্ষণ উপেক্ষা করে চলে। ডাক্তার চিকিৎসা জানে, ঔষধ জানে, কিন্তু একটি মেয়ের শরীরের কি হচ্ছে সেটা শুধুমাত্র সে নিজে বুঝতে পারবে।

 

  • অল্প বিদ্যার ফল: যেহেতু তারা নিজেদের শারীরিক সমস্যার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কথা বলতে পারেনা, মহিলারা অনেক সময়ে এমন জায়গা থেকে জ্ঞান অর্জন করে যেখানে সঠিক তথ্য সব পুরোপুরি পাওয়া যায়না। অল্প বিদ্যার ফলে আতঙি্কত হয়ে হয় সে চিকিৎসা করায়না বা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টারনেটের যুগে অনেক তথ্য আমাদের আঙুলের ডগায় কিন্তু তা অভিজ্ঞ চিকিৎসকের জায়গা নিতে পারেনা।

 

  • বিষণ্নতা আবার রোগ নাকি!: বিষণ্নতা বেশীরভাগ সময়ই সঠিক ভাবে নির্দিষ্ট করা হয় না। বিষণ্নতা , উদ্বিগ্নতা, অতিষ্ঠতা, মেজাজ খারাপ, এই সবই হল নারী শরীরে হর্মোনাল ভারসাম্যহীনতার স্পষ্ট লক্ষণ। এটা হতে থাইরয়েড , PCOD বা যন্ত্রণাদায়ক স্ত্রীরোগ ইত্যাদি নানান সমস্যা দেখা দেয় এবং তাদের মানসিক সুস্থতার উপর বিশাল প্রভাব ফেলে। লক্ষণগুলোকে মানসিক অসুস্থতার কারণ বলে অগ্রাহ্য করা হয়ে বলে মহিলারা নিরুৎসাহিত হয়ে পরে এর পেছনের আসল কারণ পরীক্ষা করাতে।

 

  • এক অসুখ, ভিন্ন লক্ষণ: ভুল যাচ এবং ভুল চিকিৎসার এটা একটা প্রধান কারণ। পুরুষ ও নারী স্বাস্থ্য অনেক ভাবে ভিন্ন। অথচ বহূ কাল ধরে এই লিঙ্গ নির্দিষ্ট ভিন্নতাকে মান্যতা দেওয়া হয়নি স্বাস্থ্য কেদ্রিক গবেষণাতে। এরকম কিছু রোগের উদাহরণ:

 

  1. বিষণ্নতা: আমাদের দ্রুতগতি জীবনধারায় পুরুষ ও নারী দুইয়ের ক্ষেত্রেই “স্ট্রেস্” খুবই প্রচলিত স্বাস্থ্যাবস্থা। কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ ভিন্ন হয়। মহিলাদের উদ্বিগ্নতা বেশী হয়, খাওয়া-দাওয়ায় প্রভাব পরে, মাথা যন্ত্রণা, ঔষধ কম কাজে দেয় এবং গভীর একাকীত্ব বোধ হয়। আত্মঘাতী প্রবণতাও মহিলাদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। উল্টদিকে বিষণ্নতা প্রবর্তিত মদ্যপান পুরুষদের বেলা বেশী দেখা যায়।
  2. হৃদরোগ সংক্রান্ত: শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা ছাড়াও, নারীদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ সম্পর্কিত আরও লক্ষণ দেখা যায় যেমন চোয়ালে ব্যথা, পেট, পিঠ ও হাত ব্যথা, অথবা বমি বমি ভাব। এগুলোকে অনেক সময়েই অ্যাসীদিটী অথবা ফ্লূ-এর লক্ষণ ভেবে অগ্রাহ্য করা হয়।
  3. হর্মোনাল ভারসাম্যহীনতা: অনেক হর্মোনের রোগ শুধুমাত্র নারীদের জন্যই প্রযোজ্য এবং এর কারণে বিষণ্নতা, নিদ্রাহীনতা, চুল পরে যাওয়া প্রভৃতি ব্যামো দেখা দেয়। পুরুষদের হর্মোনের রোগ হলে ভূরি বেড়ে যায় কিন্তু মহিলাদের ওজন বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া পূর্ণাঙ্গে হয়ে।
  4. ফুসফুসে ক্যান্সার: সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপানের প্রভাব মহিলাদের উপর বেশী হয়। পুরুষদের শরীরে ক্যান্সার কোষ ফুসফুসের ভিতরে সক্রিয় হয় কিন্তু মহিলাদের বেলায় তা ফুসফুসের বাইরের অঞ্চলে বৃদ্ধি পায়। আরও দেখা গেছে যে নারী শরীরের হর্মোন ইস্ট্রজেন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  5. ডায়াবেটিস: যদিও এই রোগ পুরুষ ও নারী দুজনেরই হয়, নারী শরীরে এই রোগের নির্ণয় করা বেশী কঠীন হয়ে কারণ এর লক্ষণ বোঝা যায় না। যোনি বা মৌখিক সংক্রমণ, ইউটিআই, যৌন কর্মহীনতার এবং PCOD, এইসবই ডায়াবেটিসের লক্ষণ হতে পারে।

 

ডঃ পলা জনসন, ব্রিঘ্যাম মহিলা স্বাস্থ্যকেদ্র এবং বস্টন মহিলা হাসপাতালের প্রধান , তার টেড টক আলোচনায় বলেছেন কিভাবে নারীদের স্বাস্থ্যের যথাযথ গবেষণার অভাবে তার গ্র্যান্ড-মাদার তীব্র বিষণ্নতার শীকার হয়েছে, রোগের সঠিক নির্ণয় না হওয়ার কারণে।

 

এরকম অভিজ্ঞতা পরিবারের কারোর জন্যই বিধ্বংসী হতে পারে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে চিকিৎসার সময় আমরা জিজ্ঞাসা করি যে নারীদের জন্য চিকিৎসায় কোনো পার্থক্য আছে কিনা; এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সঠিকভাবে সঠিক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে শিখি।

 

নারীদের অধিকার আছে পুরুষদের সমান সুস্থ জীবন যাপন করার। সময় এসে গেছে যে চিকিৎসকেরা নারীদের এক পৃথক সত্ত্বা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং বোঝে যে তাদের স্বাস্থ্য সম্বদ্ধিত সমস্যা পুরুষদের থেকে পৃথক্।

 

নারী যেমন পুরুষকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা ভঙ্গ করেছে নিজেদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও কর্ম জীবনে, সময় এসে গেছে যে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও তারা পুরুষদের সমান স্তরের অথচ নারী-সুলভ চিকিৎসা ব্যবস্থা দাবী করে।

Sai Janani

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 years ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 years ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 years ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 years ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 years ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 years ago