ভারতীয় দর্শনে শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। তার থেকেই সমস্ত কিছুর উৎপত্তি বলেও ধরা হয়। বিবাহ, অন্নপ্রাসন, পূজা পার্বণ সহ যেকোনো হিন্দু অনুষ্ঠানে শঙ্খ, করতাল, মৃদঙ্গের সাথে উলু ধ্বনি করার রীতি কিন্তু প্রচলিত রয়েছে।
এই প্রথা কেন মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেই প্রশ্ন কি জেগেছে আপনাদের মনে? কেন ছেলেদের কখনো উলু দিতে দেখা যায়না? তো চলুন আজ সেই অজানা দিকটি নিয়েই আমরা আলোচনা করবো ও আপনাদের যাবতীয় তথ্য দেব এই বিষয়ে।
উলু ধ্বনি ও নারী:
অনেকেই মনে করেন উলু ধ্বনি বাঙালি হিন্দুদের একটি সংস্কার মাত্র। উলু ধ্বনির নাম শুনলে অনেক আধুনিক মহিলাই এখন নাক সিঁটকোন বা অনেকেই উলু দিতেও পারেন না।
এর কারণ হলো অজ্ঞতা। আমাদের ধর্মীয় ও পৌরাণিক শিক্ষার অভাবেই এটা ঘটেছে। কিন্তু উলু ধ্বনি ছাড়া কোনো মাঙ্গলিক কার্য কেন সম্পন্ন হয়না সেটা জানা জরুরি।
মহিলাদের সমবেত উলু ধ্বনি শুধু দেবতাদের আশীর্বাদ ও সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয়না বরং এটি একটি পরিবেশ বিশোধন এর ক্রিয়া ও বটে। এর সাথে জড়িত মঙ্গল, শ্রী, সমৃদ্ধি ও সামাজিক বিকাশ।
উলু ধ্বনির ফলে বাতাসে যে কম্পন তরঙ্গ ওঠে তাতে পরিবেশে সমস্ত জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া মরে যায়। ফলে চারিদিক হয়ে ওঠে পবিত্র।
মহিলারা উলু ধ্বনির মাধ্যমে জগতের অশুভ ও হানিকারক ক্ষমতাকে নস্যাৎ করে সাত্ত্বিক ও শুভশক্তির আবাহন করেন। যার ফলে সফলতা নিশ্চিত হয়।
এই গুণের অধিকারী কেবল নারীদেরই, তাই এটা মেয়েরাই করে থাকেন। আর এমনিতেই শুনেই থাকবেন – “লেডিস ফার্স্ট”।
বৈষ্ণব কাহিনী মতে মেয়েদের সার্বভৌম অধিকার:
বৈষ্ণব সমাজে প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী কোনো একসময় কোন এক গ্রামে এক ব্রাহ্মণ ও তার কন্যা বসবাস করতেন। প্রতিদিন সেই ব্রাহ্মণ পবিত্রতা ও ভক্তিভরে শ্বালগ্রাম শীলা পূজা অর্চনা করতেন।
তার কন্যা তাকে পূজাপাঠে মগ্ন দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নারায়ণের উপাসনায় অনুরক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবে সারাদিনের করা ভিক্ষার সামান্য সংস্থান ও ভক্তি করেই কাটছিল তাদের জীবন।
ক্রমে বালিকা যুবতীতে পরিণত হয়ে ওঠে। রূপে গুনে বিষ্ণুর কৃপায় সে অনন্যা হয়ে ওঠে।
একদিন হঠাৎ করে এক রাক্ষস রাজের কুদৃষ্টি তার উপর পড়ে ও তিনি তাকে অপহরণ করে জোর করে বিয়ে করে নিয়ে যান নিজের রাজপ্রাসাদে।
সেখানে সেই কন্যাকে নারায়ণ পূজার অনুমতি দেয়া হয়না। দুঃখে বেদনায় তিনি নারায়ণের পায়ে অশ্রু বিসর্জন করতেন।
একদিন রাজা কোনো এক কাজে বাইরে যান। সেইসময় সেই কন্যা নারায়ণ এর পায়ে চন্দন দিয়ে তার পুজো শুরু করেন কিন্তু নিয়তির পরিহাসে রাজা ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখে ফেলেন।
শাস্তি স্বরূপ নারায়ণ শিলাকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করতে আদেশ দেন রাজা। কন্যা গঙ্গায় গিয়ে নারায়ণ সমেত নিজেকেও গঙ্গায় বিসর্জন দিতে চাইলে দৈববানী হয় নারায়ণ প্রকট হয়ে তাকে এ কাজ করতে বাধা দেন এবং বলেন যে – “এই শিলা তুমি ঘরে নিয়ে যাও। তুমি যদি আমাকে পূজা করতে চাও তবে আমাকে মন্ত্র উচ্চারণ করে সন্তুষ্ট করতে হবে না। উলু ধ্বনি করলেই আমি তৃপ্ত হবো এবং আজ থেকে আমি উলু ধ্বনি করার অধিকার সমস্ত নারীদের দিলাম। তারা একবার উলু দিলেই তাদের সমর্পণ আমি গ্রহণ করব।“
এইভাবে মেয়েদের উলু ধ্বনি করবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছেলেদের উলুধ্বনি করতে বারণ করার কারণ:
‘কুমারিকা তন্ত্রে’ অষ্টম অধ্যায়ে স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছে উলু ধ্বনি মেয়েরাই করতে পারেন। ছেলেরা উলুধ্বনি করলে তারা নির্বংশ হয়।
উলু ধ্বনি হলো একটি স্ত্রী আচার। জিভ বারংবার নাড়িয়ে মেয়েরা ধ্বনি তারতম্য করে এটি দিয়ে থাকেন। এটি একটি প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ঐতিহ্যের বাহক রূপে হস্তান্তর হয়।
আদিমকালে উলূযোগার এর মাধমে মানুষ শিকারে উলু দিয়ে বিপদ সংকেত দিত বা পরে এটি বার্তা আদানপ্রদানের কাজেও ব্যবহার হতে শুরু করে।
কথিত আছে একবার দেবতাদের স্তবে খুশি হয়ে দেবী চামুন্ডা শুম্ভ ও নিশুম্ভকে সংহার করে ডাকিনী, যোগিনী ও পিশাচিনী সহ উলু ধ্বনি দিয়ে তান্ডব নৃত্য করে বেড়ান যুদ্ধক্ষেত্রে।
এটি মূলত দেবীর উল্লাস বা হর্ষধ্বনি।সেই বিজয়গাথাকে স্মরণ করতেও উলু দেয়া হয়। যেহেতু এটি দেবী উপাচার তাই এটির উপরে মেয়েদের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ।
তা ছাড়া উলুধ্বনি জিভের আড়ষ্ঠতা বা উচ্চারণে সমস্যা দূর করে। এটির ফলে পেট সংকুচিত হয় ও নানা স্ত্রী রোগ ভালো হয়। তাই মেয়েদের এটি করার উপদেশ দেয়া হয়।