স্বাস্থ্য

গিলয় বা গুলঞ্চ কি? গিলয়ের উপকার ও ব্যবহার

গিলয় হলো একধরনের লতানো গাছ যা ভারতের ক্রান্তীয় পরিবেশে ব্যাপকভাবে বেড়ে ওঠে। ঘরোয়া চিকিৎসাবিদ্যায় এবং আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে এটির যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। সংস্কৃতে এটিকে অমৃত তুল্য বলা হয়ে থাকে।

একদম ঠিক ধরেছেন বাংলায় আমরা এই ভেষজ টিকে গুলঞ্চ নামে অভিহিত করে থাকি। তবে অনেকেই জানেন না, আমাদের পুরানে এই লতাটিকেই সোমলতা বলে অভিহিত করা হয়েছে যার রস পান করে দেবতারা অনন্ত যৌবন লাভ করতেন। বিবিধ স্বাস্থসমস্যার নিরাময়ে গিলয়ের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। এটি রস, ক্যাপসুল বা গুঁড়ো ইত্যাদি ফর্মে পাওয়া যায়।

গিলয় কেমন দেখতে?

গিলয় গাছটি দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বেড়ে ওঠে। এর পাতা গুলো রোমশ এবং পানপাতার মতো আকৃতির দেখতে হয়। বৈজ্ঞানিক নাম টিনেস্পোরা কর্ডিফেলিয়া।
মূলের অংশ বায়বীয়, কাণ্ডের উপরিভাগ খসখসে ফাটাফাটা দাগ যুক্ত হয়। কান্ড কেটে অন্য গাছ জন্ম নেয় বলে এর আরেক নাম হলো ছিন্নরূহ। গিলয়ের ঝুরি ভীষণ শক্ত হয় তাই একসময়ে সার্জারিতে ক্ষত সেলাই করার সুতোর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো।এর ভেতর পিচ্ছিল রস থাকে যা স্বাদে তিক্ত হয়। এর ফল মটর এর মত দেখতে আর ফুল হলুদাভ শ্বেতবর্ণ হয়।

গিলয়ে কি কি উপাদান থাকে?

  • গিলয় উচ্চ ফাইবার সম্পন্ন ও প্রোটিন এ সমৃদ্ধ। এই লতার ১০০গ্রাম সেবনে প্রায় ২৯২ ক্যালোরি পুষ্টিগুণ নিহিত থাকে। নানারকম কেমিক্যাল তত্ত্বের সমাহার দেখা যায় এতে যেমন – জিঙ্ক, গ্লাইকোসাইড, ক্যালসিয়াম, নিকেল, কপার, টাইটানিয়াম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি রয়েছে।
  • এছাড়াও এলকালয়েড, ডিটারপিনওয়েড, এলিফ্যাটিক ও পলিস্যাকারাইড এর মত জটিল যৌগ রয়েছে যা হেপাটাইটিস, রক্তাল্পতা, অ্যাজমা, কিডনির নানারোগের এন্টিডোট হিসেবে কাজ করে থাকে।

গিলয়ের বহুমুখী উপকারিতা:

১. ক্রনিক জ্বর ছাড়ান:

  • বহুদিনের না সারা জ্বর বা ক্রনিক ফিভার যদি থেকে থাকে তবে এই গাছের পাতা কেটে নিয়ে তা কাঁচা খেলে অথবা কান্ড ১০গ্রামের মত নিয়ে পিষে জলের সাথে মিশিয়ে ছেঁকে নিয়ে অল্প গরম করে খেলেও চমৎকার কাজ হয়।
  • এটির পাতার মধ্যে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা চরমভাবে রয়েছে। যেটা সাধারণ ফ্লু বা ম্যালেরিয়ার মতো রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা সৃষ্টি করে সুরক্ষা দেয়।

২. হজম ক্ষমতা:

  • সামান্য তেল, ঝাল ও মশলাযুক্ত খাবার দেখলেই যারা পালান অর্থাৎ পেটরোগা ব্যক্তিদের কাছে কারণসুধা হতে পারে গিলয়।
  • ২টেবিলচামচ আমলকির সাথে ১টেবিলচামচ গিলয় পাউডার একসাথে মিশিয়ে খাবার পর খান। এতে আপনার পাকস্থলীতে পিএইচ বা অম্লের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
  • চট করে ঢেকুর বা বুকজ্বালা হবেনা। আপনার হজমক্ষমতা ফিরবে। কোষ্ঠকাঠিন্য, আলসার ইত্যাদি রোগের উপসর্গগুলি ও এর খুঁজে পাবেন না।

৩. মেদবৃদ্ধি আটকান:

  • জাঙ্ক ফুড এর বাড়াবাড়ি আর মোবাইলে চোখ রেখে অলসতার পরিণাম হিসাবে জোটে শরীরচর্চার অবহেলা। ঠিকঠাক নিজেকে দেখভাল করার অভাবে জমতে থাকে ভুঁড়ি।
  • বাড়তি মেদ যাতে চেহারার সৌন্দর্যের দফারফা না করে তার জন্য ৮-১০গ্রাম গিলয় এর সাথে ১ টেবিলচামচ মধু মিশিয়ে নিয়মিত সেবন করুন।

৪. দৃষ্টিশক্তি উন্নত:

  • আজকাল ছোটবয়সেও মাওপিয়ার মতো চোখের কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। অসময়েই লেগে যাচ্ছে নাকের উপর চশমার ডাঁটি। এর থেকেও মুক্তির উপায় কিন্তু গিলয়।
  • গিলয় পাতা ভালো করে ধুয়ে নিয়ে বড় পিস করে গোল গোল শেপে কেটে নিন ১ কাপ পরিমান মতো।
  • এবার সেটা সমপরিমাণ জলে রাতভর ভিজিয়ে রাখুন। সকালে অল্প চিনি মাখিয়ে খেয়ে নিন। এটি চোখের অভ্যন্তরীণ কোষের জীর্ণতা দূর করে আর চোখ রাখে আর্দ্র।

৫. মসৃন ও ফ্ল লেস ত্বক এর রহস্য:

  • গিলয়ের জুস পান করলে ত্বক থেকে ডার্ক স্পট, ফাইন লাইন্স, ব্রণের উপদ্রব কম হয়। এতে থাকা এন্টি ইনফ্লেমেটরী উপাদান গুলি ত্বকের গভীরে যায় ও তাকে ভেতর থেকে কোজি ফিল করায়।
  • মেচেতার দাগ আর অকালে স্কিন কুঁচকে যাবার প্রবণতার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে নিয়মিত সেবন করুন আর লাভ ওঠান এর এন্টি এজিং প্রপার্টিজ এর।

৬. দুর্বলতা ও অবসাদ পিছু হটবে:

  • পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, মাথা ঘোরানো, কাজকর্মে উৎসাহ না পাওয়া সবগুলোই কিন্তু শারীরিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। রাত জেগে কাজ করা, সংসার এর স্ট্রেস এর জন্য ক্লান্তি ও অবসাদ ও ক্রমশ আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে।
  • গিলয় ও মৌরির কম্বো আপনার এই সমস্ত বাধাবিপত্তি কাটিয়ে তুলবে। মৌরি ও গিলয় পাতা জলে ভিজিয়ে রেখে, ভালোভাবে অবশিষ্ট ছেঁকে নিয়ে সেই জল পান করুন।
  • স্মৃতিশক্তি, মানসিক স্থিরতা ও চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে এই টোটকা।

৭. ডায়াবেটিসের যম:

  • সুগার ফ্রি জীবনে আপনার যদি সবকিছু ফিকে আর নিরস মনে হয় তবে সঙ্গে নিন গিলয়কে আর ডায়াবেটিস করুন হাতের মুঠোয়।
  • গিলয়ের নির্যাস জলের সাথে পান করুন দিনে একবার যা আপনার শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন বাড়াবে আর সেই হারে রক্তে কমাবে শর্করা।

৮. সামগ্রিক নিরাপত্তা:

  • গিলয় আপনার শরীরের সার্বিক সুরক্ষার বিষয়টিও খেয়াল রাখে সযত্নে। শরীর থেকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং শরীরের ক্ষতিকারক টক্সিনগুলো নিষ্কাশ করে দেয়। এটাকে একপ্রকার বিশোধক প্রক্রিয়া ও বলা যায়।
  • ত্বক জেল্লাদার হয়ে ওঠে কারণ গিলয় ফ্রি রাডিক্যাল মুক্ত করে যেহেতু এটি এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। যার ফলে শরীরের জৈবনিক তন্ত্র চনমনে হয়ে ওঠে।

৯. আর্থ্রাইটিস সমাধান:

  • আর্থ্রাইটিসে দিনের পর দিন অনেকে ভোগেন অনেক ওষুধ খেয়েও তার কোন প্রতিকার পান নি। তারা নিশ্চিন্তে ভরসা করতে পারেন এই আয়ুর্বেদিক ভেষজটিকে।
  • গিলয়ের সাথে আদা মিশিয়ে সেটি হালকা গরম করে খেতে পারেন। গিলয়ের মধ্যে থাকা সাইটোকাইন উপাদানটি হাড়ের প্রদাহের বিরুদ্ধে এন্টিবডি গড়ে তোলে যার ফলে এটি যথেষ্ট কার্যকরী সিদ্ধ হয়।

১০. পুরোনো চর্মরোগ সারান:

  • বহুদিনের পুরোনো একজিমা, র‍্যাশ বা দাদের সমস্যা থাকলে গিলয়ের শরণাপন্ন হতেই পারেন। এর জন্য সিম্পল উপায় ফলো করতে হবে।
  • করমচা বীজ নিন ৪-৫টি আর গিলয়ের নির্যাস নিন ১ কাপ মতো। এই দুটোকে একসাথে গরম জলে ফুটিয়ে নিন মিনিট পাঁচেক।
  • ঠান্ডা করে আক্রান্ত জায়গায় লাগান। ফল পেতে অপেক্ষা করুন একমাস মতো।

অন্যান্য গুণাবলী:

  • অরুচি বা খাবারে অনীহা দেখা যদি যায় যেটা বদহজম বা ক্লান্তি যেকোনো কারণেই হতে পারে, তার জন্য এর পাতা গুলো ভেজে খেতে পারেন ক্ষুধামান্দ্য সেরে যাবে।
  • বাতের যন্ত্রনায় যদি ভোগেন তবে দুধের সাথে এর পাতা বেটে খেয়ে দেখুন উপকার পাবেন হাতেনাতে।
  • হৃদরোগ বা শ্বাসকষ্ট সম্পর্কীয় যেকোনো সমস্যায় চটজলদি এফেক্ট পাবেন গোলমরিচ ও গিলয় একসাথে মিশিয়ে খেলে।
  • অর্শ হোক বা কৃমি এসব কিছু থেকে নিমেষে সুরাহা দেবে গিলয়ের পাতা বেটে খেলে।
  • পুবারটির সময় অনেকের স্বরভঙ্গ হয় এবং অনেকসময় সেটা মোটা ও স্থূল হয়ে বিচ্ছিরি শুনতে লাগে। তার জন্যেও এটা কাজে লাগাতে পারেন। টনসিলের উপর কার্যকারিতা প্রবল।
  • পক্স হলে হাত, পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা হয়। গিলয়ের মধ্যে অর্গানিক পেন কিলিং এজেন্ট রয়েছে যেটা জলে এর রস গুলে হাতে পায়ে মেসেজ করে দিলে উপশম হয়।

কিভাবে ব্যবহার করবেন গিলয়?

  • গিলয় ব্যবহার এর জন্য কান্ড ও পাতা থেকে ক্কাথ বের করে পাউডার বা ডাস্ট করে নিয়ে স্টোর করে রাখতে পারেন।
  • বাজারে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা লিকুইড ফর্মে পেয়ে যাবেন। তবে এসব থেকে যদি এলার্জি থেকে থাকে তবে হার্বাল চা এর সঙ্গে পান করতে পারেন।
Biswarup Parichha

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago