Most-Popular

কলা বউ স্নান দিয়ে পুজোর সূচনা কেন হয়?

দুর্গা পুজো আর বেশি দেরি নেই, আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তারপর‌ই ষষ্ঠী থেকে নবমীর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখা, প্রচুর খাওয়া-দাওয়া ও মোবাইল ভর্তি সেলফি তোলার পর ঠাকুরের বিদায় বেলায় সকলের চোখ ছলছল করে ওঠে। আবার শুরু হয় এক বছরের প্রতীক্ষা। এই ভাবেই বাঙালির প্রাণের দুর্গোৎসব অন্তরের পুজো ঘুরেফিরে আসে প্রতিবছর। কিন্তু দুর্গা পুজোর সবথেকে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো কলা বৌ স্নানের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সূচনা। কেন কলা বৌ স্নানের মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয়, সেইসব বিষয়ে বলতেই আমি হাজির।

দেবীদুর্গা বছরের চারটে দিন কৈলাস থেকে মর্ত্য ভূমিতে আসেন সপরিবারে, এই পরিবারের মধ্যেই থাকেন কলা বৌ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী গণেশের বউ কলা বউ, কিন্তু অনেকেই জানেন না এই ধারণাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কলা বউ কিন্তু গণেশের বউ নন। কলা বৌয়ের আসল পরিচয় কী? হ্যাঁ বন্ধুরা কলা বৌয়ের আসল পরিচয় কী তা জানলেই এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে কেন কলা বৌ স্নানের মধ্যে দিয়েই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়।

১. কলা বৌ এর অবস্থানঃ

দুর্গাপুজোয় দুর্গার পরিবারের সাথেই কলা বৌ থাকেন। লাল শাড়িতে বধূ বেশে কলা বউকে দেখতে পাওয়া যায় পুজো মণ্ডপে। তার অবস্থান গণেশের ঠিক পাশেই।

২. কলা বৌ সম্পর্কে ভুল ধারণাঃ

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সকলে ভাবেন যে, কলা বৌ গণেশের স্ত্রী। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তথ্য। গণেশের দুই স্ত্রী। তাদের নাম রিদ্ধি ও সিদ্ধি। আর তাছাড়া দেবতাদের স্ত্রীরা সবসময় পতিদেবতার পাশে থাকেন। কলা বউ যদি গণেশের বউ হতেন, তাহলে তিনি গণেশের বাম দিকে অবস্থান করতেন। কিন্তু কলাবৌ গণেশের ডান দিকে অবস্থান করেন। তাই তিনি গণেশের বৌ নন। যারা ভাবেন কলা বউ গনেশ দেবতার বউ, তারা অঞ্জতার বশবর্তী হয়ে এমনটা বলেন।

২. কলা বৌ আসলে কে?

দুর্গা পুজোর মধ্যে মহাসপ্তমীর দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় কলা বউ এর স্নান। আর কলাবৌয়ের স্নানের পর তাকে মা দুর্গার পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তারপর শুরু হয় মূল পুজো। কিন্তু কে এই কলা বৌ? কলাবউ এর পরিচয় শুনলে অনেকেই চমকে উঠবেন, হ্যাঁ যাকে গণেশের স্ত্রী ভাবা হয় তিনি আসলে গণেশের স্ত্রী নন, গণেশ জননী! কলা বৌ আসলে দেবী দুর্গার একটি রূপ আর দেবী দুর্গার একটি রূপ হিসেবেই কলাগাছকে মন্ডপের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কলা বৌ হল আসলে নবপত্রিকা যা‌ দেবী দুর্গার বৃক্ষ রূপ।

৩. নবপত্রিকা কী?

মা দুর্গার নয় রূপের প্রতীক হলো নবপত্রিকা। নবপত্রিকা অর্থাৎ গাছের নয়টি পাতা। এই নয়টি গাছ মায়ের নয় রূপকে চিহ্নিত করে। এই নয়টি উদ্ভিদ হলো- রম্ভা অথবা কলাগাছ, কচু গাছ, হরিদ্রা অথবা হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব অর্থাৎ বেল, দাড়িম্ব অর্থাৎ ডালিম গাছ, অশোক গাছ, মান গাছ, ধান গাছ। এই নয় গাছ দেবীর যে নয় রূপকে বোঝায় সেই নয়টি রূপ হল-ব্রহ্মাণী, কালিকা, উমা, কার্তিকী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকরহিতা, চামুন্ডা ও লক্ষী। তবে এই নয় দেবীর মধ্যে একমাত্র দেবী চামুণ্ডা ছাড়া অন্য কোন দেবীর আবাহন ও পুজো হয়না।

কলাগাছ হলো দেবী ব্রহ্মাণীর প্রতীক স্বরূপ, কচু গাছ দেবী কালিকার প্রতীক। দেবী উমার প্রতীক স্বরূপ গাছ হলো হরিদ্রা গাছ। দেবী কার্তিকীর প্রতীক জয়ন্তী গাছ। দেবী শিবার প্রতীক বিল্ব গাছ। দেবী রক্তদন্তিকার প্রতীক গাছ হলো দাড়িম্ব বৃক্ষ। দেবী শোকরহিতার প্রতীকস্বরূপ গাছ হলো অশোক গাছ। মান গাছে অধিষ্ঠান করেন দেবী চামুণ্ডা, ধান গাছে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন লক্ষী। তাই যেহেতু নবপত্রিকা দেবীর রূপ তাই কলা বৌ স্নানের মধ্যে দিয়েই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়।

৪. ২০২১ সালের দুর্গা পুজোর নির্ঘন্ট হলো-

১১ অক্টোবর অর্থাৎ ২৪ শে আশ্বিন হলো মহাষষ্ঠী
১২ অক্টোবর অর্থাৎ ২৫ শে আশ্বিন হলো মহাসপ্তমী
১৩ অক্টোবর অর্থাৎ ২৬ শে আশ্বিন হলো মহা অষ্টমী আর ১৪ অক্টোবর অর্থাৎ ২৭ শে আশ্বিনে মহানবমী। বিজয়া দশমী হলো ১৫ অক্টোবর অর্থাৎ ২৮ শে আশ্বিন। এরমধ্যে মহাসপ্তমীর দিন অর্থাৎ ১২ অক্টোবর কলা বৌয়ের স্নান ও প্রতিষ্ঠা হবে।

৫. মহা সপ্তমীর দিন নবপত্রিকাকে বধূর আকার দেওয়াঃ

এই মহাসপ্তমীর দিন একটি সপত্র কলা গাছের সাথে আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদকে একত্র করে একজোড়া বেল শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় ও লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকারে ‌সজ্জিত করা হয়। এরপর এই কলাগাছের সিঁদুর পরিয়ে দেবী প্রতিমার পরিবারের ডানদিকে রাখা হয় ও এই ভাবেই পুজো করা হয়। নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ কে একসাথে নবপত্রিকা বাসিনী নবদুর্গা নামে পুজো করা হয়।

৬. নবপত্রিকার প্রণাম মন্ত্রঃ

নয় উদ্ভিদকে নয় দেবীর রূপ হিসেবে কল্পিত করে পুজো করা হয়। একসাথে নয় দেবীকে ‘নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পুজো করা হয়।

৭. গবেষকদের মতে নবপত্রিকা শস্যদেবীঃ

গবেষকরা মনে করেন যে নবপত্রিকার পুজো প্রকৃতপক্ষে শস্য দেবীর পুজো। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত নবপত্রিকার পূজা সম্পর্কে বলেছেন, “ এই শস্য বধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পুজো করতে হয় তাহার কারণ শারদীয়া পূজার মূলে বোধহয় এই শস্য দেবীর পূজা। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দুর্গাপুজোর বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হ‌ইয়াছে… বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্য দেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটি সচেতন চেষ্টা। এই শস্য দেবী মাতা পৃথিবীর‌ই রূপভেদ। সুতরাং আমাদের ঞ্জাত ও অজ্ঞাতসারে আমাদের দুর্গাপুজোর ভিতরে এখনো সেই আদি মাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।”গবেষকরা যাই বলুন, সব শেষে গবেষকরা নবপত্রিকাকে শস্য দেবী রূপে মেনেছেন। আর শাস্ত্রে দেবী দুর্গাকেই তো শস্যদেবী বলা হয়,তিনিই তো অন্নপূর্ণা আবার তিনিই জগতের সমস্ত কিছুর সৃষ্টি।

৮. পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখঃ

মার্কন্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও সপ্তমী তিথিতে নব পত্রিকা পুজোর নির্দেশ আছে আবার কৃত্তিবাস ওঝার রচিত রামায়ণেও নব পত্রিকা পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। রামচন্দ্র নবপত্রিকা পুজো করেছেন বলে লেখা আছে যে,“ বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।”‌ ভবিষ্য পুরাণে এও নব পত্রিকার উল্লেখ পাওয়া যায়,“‌ অথ সপ্তম্যং পত্রিকা প্রবেশন বিধিঃ”

৯. নবপত্রিকা পুজোর আচারঃ

মহা সপ্তমীর দিন সকালে কাছাকাছি থাকা কোন জলাশয়ে নবপত্রিকাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকাকে নিয়ে যান। পুরোহিতের পিছনে পিছনে ঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যান ও সমস্ত মহিলারা শঙ্খ ধ্বনি ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। এরপর শাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী নবপত্রিকাকে স্নান করানো হয় এবং নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পড়ানো হয়। তারপর পুজোমণ্ডপে নবপত্রিকাকে নিয়ে গিয়ে দেবীর ডান দিকের একটি কাঠের সিংহাসনের নবপত্রিকাকে স্থাপন করা হয়। পুজোমণ্ডপে নবপত্রিকাকে প্রবেশ যখন করানো হয় সেই প্রবেশের মধ্য দিয়েই দূর্গা পূজার মূল অনুষ্ঠানের প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকাকে প্রবেশ করানোর পর দর্পণে দেবীর মহাস্নান করানো হয়। এরপর পুজোর চারদিন গুলিতে নবপত্রিকা-দেবী দুর্গা ও তার পরিবারের সাথেই পূজিতা হন।

১০. নব পত্রিকাকে পুজো করার ফলঃ

নবপত্রিকাকে প্রতিষ্ঠা ও পুজোর মধ্য দিয়ে প্রথমত প্রকৃতিই যে আমাদের মা সেই বিশ্বাসটা আমাদের অভ্যন্তরে গেঁথে যায়। নবপত্রিকা মধ্য দিয়ে দেবীর রূপের প্রতি শরণাগতি জানানো হয়, ফলে দেবীর কৃপা প্রাপ্ত হওয়া যায়।

Sangita Chowdhury

Recent Posts

মুখের রোমকূপ বা পোরস ঢাকার মেকাপ টিপস

আপনার মুখের রোমকূপ বা পোরসগুলি কি খুবই বড় বড়? আপনি টেকনিক্যালি এইসমস্ত পোর্স ছোট করতে…

2 বছর ago

থুঁতনির জেদি ব্ল্যাকহেডস তোলার ৬টি উপায়

পরিষ্কার নিটোল মুখ, অথচ থুঁতনিতে কালো কালো ব্ল্যাকহেডস! কেমন লাগে বলুন তো! সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে…

2 বছর ago

মেয়েরা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় যে ১০টি জিনিস অজান্তেই করে

আগেকার দিনে বলা হত, লজ্জা নাকি নারীর ভূষণ। না, আজকের দিনে আমরা ওইসব কথা বলব…

2 বছর ago

ঘরের দেওয়ালে নোনা ধরছে? দূর করুন ঘরোয়া কৌশলে

বাড়ির দেয়ালে রকমারী রঙের ছ্বটা অনেকেরই সাধ ও শখের পরিচয় বহন করে। কিন্তু কিছু বছর…

2 বছর ago

ময়েশ্চারাইজার কেন এত উপকারি ত্বকের যত্ন নিতে? ব্যবহারের সঠিক নিয়ম।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত এই কথাটা আমরা সবাই জানি কম বেশি। কিন্তু কেন? কি উপকার…

2 বছর ago

নারকেল তেল দিয়ে ত্বকের যত্ন! উজ্জ্বল, চকচকে ত্বকের গোপন রহস্য!

প্রাচীনকালে যখন রূপচর্চার এত উপকরণ হাতের কাছে ছিল না, সেই সময় থেকেই রূপচর্চার অন্যতম উপকরণ…

2 বছর ago