উলু ধ্বনি বাঙালিরা কেন দেয়? নানা অনুষ্ঠান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে?
কথায় বলে বাঙালীর বারমাসে তেরো পার্বন। উৎসব-অনুষ্ঠান বাঙালীর সভ্যতা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সন্ধ্যাপূজা থেকে আরম্ভ করে যেকোনো পূজা পার্বণ তথা বিয়েবাড়ি সহ যেকোনো মাঙ্গলিক কর্মকান্ডে শঙ্খ, কাসর, ঘন্টা, ঢাক ইত্যাদির সাথে যেটা আমাদের কর্ণগোচর হয় তা হলো মহিলাদের সমবেত উলু ধ্বনি।
এমনকি নজরুলের কবিতাতেও আমরা শুনি –“উলু দেয় পুরনারী”। তবে এককালে বাঙালী হিন্দুদের অন্যতম সনাতন উপাচার এখনকার আধুনিক সমাজের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত। অনেক মেয়েরাই ঠিক মতো উলু দিতে পারেন না, বিব্রত বোধ করেন। বাঙালী সংস্কৃতির সাথে শিকড়ের যোগের কথা ভুলে গিয়েছি আমরা নিজেদের অজান্তেই।
তাই চলুন আজকে আমরা উল্লেখ করবো বাঙালী মেয়েরা ঠিক কোন কারণে উলুধ্বনি দেয় এবং এর নানা উপকারিতার কথা।
উলু ধ্বনির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
ধ্বনিগত দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উলু ধ্বনি হলো ওঁ কার ধ্বনি। ওঁ- যা পরমব্রহ্মের নিয়ত স্বরূপ বলে হিন্দুধর্মে মান্য করা হয়।
অপরপক্ষে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের মত হলো, উ হলো রাধা এবং লু হলো কৃষ্ণ তাই উলু ধ্বনির দ্বারা আমরা এই দুই যুগলকেই স্মরণ করি।
উলুধ্বনি অ, উ এবং ম এই তিনটি বর্ণ নিয়ে গঠিত। এই তিনটি ধ্বনি আত্তীকরনের মাধ্যমে উচ্চারণের একটি সংহতি তৈরি করে যা মহাশূন্যে ব্রহ্মনাদকে কম্পিত করে। একপক্ষে বলা যায় এটি মহাচৈতন্য জাগরণ এর উদ্ধোক।
ওঁ শব্দটি সংস্কৃত ‘অব’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন এবং ১৯টি অর্থযুক্ত। ব্যুৎপত্তি গত অর্থ ধরলে ওঁ হলো সকল শক্তির কারক, বাহক ও ধারক। সমগ্র ব্রম্ভান্ড ব্যাপী অজ্ঞান হরণকারী, সর্বজ্ঞ ও মঙ্গলময় উৎস।
অ-কার আপ্তি বা আদিমতত্ত্ব বা সূচনার প্রতীক। উ- কার সমৃদ্ধি বা উৎকর্ষ বা অভেদত্ত্বের প্রতীক। ম- কার মিতি বা অপিতি শক্তির প্রতীক বলে মনে করা হয়ে থাকে।
আধ্যাত্মিক কারণ:
উলু ধ্বনির অ, উ এবং ম এই তিনটি ধ্বনি কিন্তু সৃষ্টি,স্থিতি ও লয়কেও বোঝায়।অনেকে বলেন যে এটার দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে বোঝানো হয়।মান্ডুক্য উপনিষদেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
উলু ধ্বনিতে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তা কিন্তু আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কেবল একটি মাঙ্গলিক কাজের সূচনা করে তাই নয় একটা দৈব বাতাবরণ সৃষ্টি করে যার দ্বারা দেবতাদের আশীর্বাদ প্রাপ্তির একটি মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়।
উলু ধ্বনির শব্দে শুভকাজের পবিত্রতা বহুগুণে বেড়ে এবং অশুভ শক্তি সেই জায়গায় আর না থাকতে পেরে বিতাড়িত হয় বলে মনে করা হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় উলু ধ্বনি দেবার কারণ:
নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদিতে উলু ধ্বনি দেবার চল রয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। কিন্তু আমরা তার আসল কারণ না জেনেই সেগুলোকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস বলে উপহাস করি।
উলু ধ্বনি যে সময় থেকে দেয়া হতো সেই সময়ে ফেসবুক বা টুইটার এর অস্তিত্ব ছিলোনা। সেই সময়ের মানুষ গণমাধ্যমের একটি সংকেত হিসেবে এটিকে ব্যবহার করত।
এটি সমষ্টিগতভাবে কোনো উঁচু জায়গা থেকে করা হতো যাতে মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে।বৈজ্ঞানিক দিকথেকেও এই বিপদ সংকেতের একটা ব্যাখ্যা মেলে এই কারণ দেখলে।
অন্যদিকে প্রাচীন সময়ে জঙ্গলে প্রচুর শ্বাপদ জন্তুর দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। উলু ধ্বনি দিলে সেই জানোয়ার কাছে আসত না সেই কারণেও এটি করা হতো।
অনেকে দেবদেবীদের কোপ থেকে কৃপা প্রার্থনা করার জন্য ও দুর্যোগের সময় উলু ধ্বনি করে থাকেন অবশ্য।
উলু ধ্বনির খুঁটিনাটি:
উলু ধ্বনি হলো জিহ্বা কম্পনের ফলে সৃষ্ট উচ্চগ্রামের ভোকাল সাউন্ড যার উৎপত্তি মধ্যযুগে।
উলু ধ্বনির একটা সাউন্ড কোড থাকে যা ঝড় নামে খ্যাত। ঝড় বলতে বোঝায় একটি শ্বাস চক্রের সম্পূর্ণ হতে যতটা সময় লাগে সেই সময় মাত্রা।